গল্প: শেষ বিকেলের আলো
২য় পর্ব
লেখা: Nilofa Nilo( উম্মে জাবির)
সুমাইয়া সেদিনের পর থেকে চুপ হয়ে গিয়েছিলো। বাবা-মায়ের পছন্দ করা পাত্রের সাথেই সুমু বিয়েতে রাজী হয়ে যায়। স্বামীসহ সে দুবাইতে সেটেলড হয়ে যায়। শুনেছি সে সুখে আছে।
লুকিয়ে অনেক কান্না করেছি, খুব কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু আমি নিজেকে বুঝিয়েছি এতেই আমার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যান নিহিত রয়েছে।
বাবার অন্যত্র বদলী হওয়ায়, ইন্টার পরীক্ষার পর আমরা এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যাই। ময়মনসিংহ মেডিকেলে চান্স পাওয়াতে একেবারেই দাদার বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। অনেকসময় মন আকুপাকু করতো সুমাইয়ার কেমন আছে জানার জন্য কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করেছি। কারো কাছেই জিজ্ঞাস করিনি। হয়তো ভয় পেয়েছিলাম, যদি না আবার সুমুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি, আরো বড় গুনাহে লিপ্ত হয়ে যাই!!
অনেক কষ্টে একটু একটু করে সুমুর কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি।
একদিন আপুর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, সুমাইয়া স্বামীর সাথে ভালো নেই। একটু আগ্রহী হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, কী হয়েছে? আপু বললেন,
সুমুর স্বামী মদ্যপায়ী, খারাপ লোক। রাত বিরাতে বউকে এসে পিটায়।
এসব শুনে খুব কান্না করেছিলাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে, এক আকাশ ভরা জ্যোৎস্নাকে মনে হচ্ছিলো, আমার সাথে ব্যঙ্গ করছে। এই জ্যোৎস্নাই তো সুমু ভালোবাসতো।
নিজের বিবেককে ন্যায়, অন্যায়, পাপ সম্পর্কে বুঝাতে পারি। কিন্তু মনকে তো বুঝাতে পারি না। মন তো বলে,
সুমু আজ যে কষ্টে আছে সব আমার কারণেই। যদি আমি সুমুকে একটু সাপোর্ট দিতাম হয়তো, আজ তার এই পরিণতি হতো না। সেও কোন মেডিকেলের স্টুডেন্ট হতো। হয়তো আমার সাথে জেদ করেই নিজের চেয়ে ১৫ বছরের বড় কাউকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলো। জানি টাকা পয়সার প্রতি ওর লোভ কখনোই ছিলো না।
একসময় ওকে বলেছিলাম, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। যদি বাবা রাজি না হয়, প্রয়োজনে মরে যাবো, পালিয়ে যাবো তাও আমরা আলাদা হবো না।
দ্বীনের জ্ঞান আসার পর থেকে, বুঝতে পারলাম কতই না ভুলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি বুঝতে পারলাম,
"হয়তো আমার মনে হচ্ছে সুমুকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। কিন্তু যদি ওর সাথে আমার সুখ লেখা না থাকে, যদি ওর সাথে অকল্যান থাকে তবে বিয়ের পর ওর সাথে আমার সংসার করা বিষের মতো হবো, মনে হবে কেন যে প্রেম করে বিয়ে করলাম, ঝগড়া লেগে থাকবে, সুখের দেখা পাওয়া খুব কঠিন মনে হবে। কিন্তু আমি ওকেই চাই কখনো আল্লাহকে বলিনি।
যদি কারো সাথে প্রেম হয়ে থাকে দ্বীনের জ্ঞান আসার পর প্রথম দায়িত্ব হয়তো একে অপরকে বিয়ে করে নেওয়া। নয়তো কোন সম্পর্ক না রেখে আল্লাহর ফয়সার উপর ছেড়ে দেওয়া। আমি তাই করেছি।"
ধীরেধীরে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরতে শিখে গিয়েছি, আল্লাহর কাছে চেয়েছি,
আল্লাহ যেন সুমুকে ভালো রাখেন। আর আমার মন থেকে সুমাইয়ার অস্তিত্বও ভুলিয়ে দেন এবং সুমাইয়ার মন থেকেও। তাই হলো, একটা সময় আসলো সুমাইয়াকে পুরোপুরি ভুলতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। নিজের পড়ালেখা, কাজ নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি সুমাইয়া মনের কোণায় ভুল করেও উঁকি দেয়নি।
"মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে।ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে।"
[সুরা আন নূর ২৪ঃ৩০-৩১]
রাসুল (সঃ) বলেন, হে আলী ! তুমি হঠাৎ কোন মহিলার উপর দৃষ্টি পড়ার পর দ্বিতীয়বার ইচ্ছা করে তাকাবে না । কারন প্রথমবার অনিচ্ছাকৃত তাকানো তোমার জন্য মাফ হলেও দ্বিতীয়বার ইচ্ছাকৃত তাকানো মাফ নয় ।
[সুনান আবু দাউদ শরীফ-১/২৯২]
এমনকি এই কোরানের আয়াত আর হাদীসের উপর আমল করার কারণে কোন মেয়ের দিকে দৃষ্টিই দেওয়া হয় না আলহামদুলিল্লাহ।
হয়তো সুমুও ভুলে গিয়েছে।
আমিতো আল্লাহর কাছে এটাই চেয়েছি। সুমুও আমাকে ভুলে যাক সুন্দর করে সংসার করুক।
বেশ কয়েকবছর কেটে গেলো, ডাক্তার হয়ে বের হলাম আলহামদুলিল্লাহ। একটি হাসাপাতালে আছি, পাশাপাশি প্রাইভেট প্রেকটিস করি এবং প্রতি শুক্রুবার আমার নিজের গ্রামে যাই।
হঠাৎ এক শুক্রুবারে কালো বোরখা, নেকাব পরিহিতা এক রোগী আসলেন,
--আসসালামু আলাইকুম।
: ওয়ালাইকুম আসসালাম ওরাহমাতুল্লাহ
আমি একবার দেখেই চোখ নামিয়ে নিলাম।
খানিকটা অবাক হলাম, সুন্নত সম্পর্কে সচেতনতা দেখে। যেহেতু সালামের উত্তর বাড়িয়ে দিয়েছেন। সালামের উত্তর একটু বাড়িয়ে দেওয়া সুন্নত।
এই এলাকায় এমন কাউকে তো চিনি না।
যাক আমার এসবের ভাবার কী দরকার!
--নাম? (প্রেস্ক্রিপশনে লিখার জন্য)
: বিনতে আবুল কাসেম!!
সালাম শুনেও আওয়াজ পরিচিত মনে হয়েছিলো, কিন্তু নাম শুনে এবং নাম দেওয়ার স্টাইল শুনে, আওয়াজটা আরো একবার শুনে চমকে উঠলাম! নীচের দিকে তাকিয়েই ভাবতে লাগলাম। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা উঁকি দিচ্ছে।
সুমু ছিলো খুব আধুনিক মেয়ে, সে কীভাবে এতটা পর্দানশিন হয়ে গেলো!? সুন্নত সম্পর্কে এতটা সচেতনতা তার মধ্যে কখন আসলো! তাহলে কী সুমুও দ্বীনের পথে ফিরেছে? আলহামদুলিল্লাহ। অনেক বছর আগে শুনেছিলাম, সুমু ভালো নেই, তা ভুলে গেলাম!!
নিজের মনেই ভাবলাম তবে সুমু স্বামী নিয়ে বেশ ভালোই আছে। হৃদয়ের মণিকোঠায় একটু মন খারাপ ভাব আসলেও ঠোঁটের কোণায় এক প্রশান্তি হাসি এসেই মিলে গেলো।
অনেক কিছুই তার মুখ থেকে জানতে ইচ্ছে হলেও, নিজেকে শান্ত করলাম। কিছুই জিজ্ঞাস করলাম না। সব সমস্যা জেনে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলাম।
যাওয়ার সময় বললো,
--কেমন আছি জিজ্ঞাস করারও প্রয়োজন মনে করলে না?
নীচের দিকে তাকিয়েই বললাম,
--ভালই তো আছ, আর কী জিজ্ঞাস করবো? তাছাড়া,,,,
সুমাইয়া আমাকে আর বলতে না দিয়ে, থামিয়ে দিয়েই চলে গেলো। বুক ছিঁড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেলো!
মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, রোগী দেখাই মনযোগী হলাম।
সেদিন বাসায় এসে, মায়ের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম,
সুমু দেশে এসেছে প্রায় এক মাস, সুমাইয়ার ডিভোর্স হয়েছে!! স্বামী রাত বিরাতে এসে মারতো, সারারাত মেয়ে মানুষ নিয়ে পড়ে থাকতো!! একদিন মারের এক পর্যায়ে সুমাইয়ার তিন মাসের প্রেগন্যান্সির মিসকারেজ হয়ে যায়। সেই যে সুমাইয়ার বাচ্চাটা নষ্ট হলো, সুমাইয়া আর মা হতে পারেনি। মেয়েটি পাগলের মতো হয়ে যায়। বাচ্চাটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন ছিলো। যেটাকে আমরা নিজেদের জন্য ক্ষতির, কষ্টের মনে করি; আল্লাহর পরিকল্পনায় সেখানে হয়তো আমাদের জন্য ভালো কিছুই লেখা হয়। আলহামদুলিল্লাহ!
চলবে,,,,,
No comments:
Post a Comment