গল্পঃ শেষ বিকেলের আলো
৩য় পর্ব
লেখা: Nilofa Nilo(উম্মে জাবির)
সুমাইয়ার ব্যপারে এসব কথা শুনে নিজেকে খুব বেশি আহত মনে হচ্ছিলো। ফুলের মতো নিস্পাপ একটা মেয়ের জীবনে এত এত পরীক্ষা, না জানি মেয়েটা সহ্য করতে পারছে কি না। আল্লাহ সুমুর সহ্য শক্তি বাড়িয়ে দাও।
মায়ের কাছ থেকে আরো শুনলাম, বাড়ির সবাই সুমুর ডিভোর্স করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু সুমু কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। সে আবার সেই কষ্টের জীবনে ফিরে যেতে চায়!! নিজেকে আবার খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো। কেন একটিবারের জন্যও সুমুর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি! কেন সুমুকে সামনে পেয়েও একটিবারের জন্যও জানতে চেষ্টা করিনি, সে কেমন আছে! হয়তো সুমু সুখে থাকলে মানবিক হিংসা হতো কিন্তু শান্তি, তৃপ্তি পেতাম!!
কী আজিব মানুষ আমি!! সে হয়তো এক বুক অভিমান নিয়েই ফিরে গিয়েছিলো!
কিন্তু আমার যে করার কিছুই নেই।
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো, আমার সুমু খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসতো। না, না সে আমার সুমু নয়। সে এখন অন্য কারো। অনেক কষ্টে যাকে ভুলতে পেরেছি আল্লাহর জন্য, আজ তাকে আবার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে, বার বার। আমি নিজেকে শত কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করলেও কিছুতেই নিজের মনকে মানাতে পারছি না যে, সুমু ভালো নেই। তাকে ফিরাতেই হবে। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। শুধু ভেবেছি কী করা যায়? কী করার আছে?
আবার হাসপাতাল, চেম্বার, রোগী নিয়ে ব্যস্থ হয়ে গেলাম। সারাদিনে আর সুমুর কথা মনে না পড়লেও, রাতে ঘুমানোর সময় মনের কোণায় সুমুর নিস্পাপ হাসিটা উঁকি দিয়ে যায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে! এভাবে প্রায় একমাস চলে যায়। মাঝেমাঝে মন খুব আকুপাকু করে, একটু মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করি সুমু কেমন আছে? কিন্তু জড়তায়, সংকোচে আর জিজ্ঞাস করা হয় না।
সেদিন খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, মায়ের সাথে কথার এক পর্যায়ে জিজ্ঞাস করলাম,
--মা, সুমাইয়ার ডিভোর্স হওয়ার কথা ছিলো, কতটুকু এগোলো?
: বলিস না, মেয়েটা পাগলি! ছোট বেলা থেকেই জিদ্দি টাইপের ছিলো এখনো সেই থেকে গিয়েছে? এখন তো মোটামোটি ধর্ম মানে। বলে কি না, ধৈর্য ধরবো! কপালে যা আছে তাই হবে।
--কিন্তু মা, ইসলামেও তো মনের মিল না হলে ডিভোর্সের কথা লিখা আছে। তাছাড়া অনেক সাহাবিদেরও ডিভোর্স হয়েছিলো। ডিভোর্স যদি শুধু খারাপের হতো তাহলে সাহাবিরা কখনো ডিভোর্স নিতেন না। ধর্ম মানলেই ডিভোর্স নিতে পারবে না এমন তো নয়।
খানসা বিনতে খিদাম (রা:) এর স্বামী উহুদ যুদ্ধে শহীদ হলেন, তার বাবা তাকে এক ব্যাক্তির নিকট বিয়ে দিয়ে দেন।
তখন হযরত খানসা (রা:), রাসুল (স:) কাছে এসে বললেন, ‘‘আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন; অথচ আমি আমার সন্তানের চাচাকেই অধিক পছন্দ করি।”
[সাহীহ বুখারী,৮ম খন্ড, ৬০৫৪ ও ৬০৫৩]
এরপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তার বিয়ে ভেঙ্গে দিলেন। রাসুল (স:)ই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলেন।
হ্যা ধৈর্যের ফল অমূল্য, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। কিন্তু,,
মা আমার কথার মাঝখানেই বললো,
: কিন্তু সেটা তাকে কে বুঝাবে? আহারে! মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট হয়, আল্লাহ এইটুকুন বয়সেই তাকে কত বেশি পরিক্ষার সম্মুখীন করেছেন। জীবনে সুখ কী জিনিস দেখেনি। বিয়ের পর থেকে স্বামীর সুখ কী জিনিস তো মেয়েটি বুঝে উঠতে পারেনি। অনেক কষ্টে একটা বাচ্চা, তাকেও হারালো।
--মা চিন্তা কর না, নিশ্চয় দুঃখের পর সুখ রয়েছে। দুনিয়াতে না পেলে নিশ্চয় আখিরাতে পাবে ইন শা আল্লাহ।
আমি আবার ভাবনায় পড়ে গেলাম।
শেষপর্যন্ত সুমুর সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জানি নিজেকে ঠিক রাখতে পারাটা কঠিন হবে, কিন্তু সুমাইয়া জীবন বাঁচানোও খুব জরুরি। এতদিন দ্বীন প্রেক্টিসে নিজের মনের উপর এতটুকু বিশ্বাস অর্জন করেছি, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো ইন শা আল্লাহ। ঠিক যতটুকু কথা বললে পর্দার হুকুম লঙন হবে না, ততটুকুই বলবো!! সুমাইয়ার নাম্বার নিয়ে কল দিলাম, সালাম বিনিময়ের পর বললাম,
--আমি একটু আপনার সাথে দেখা করতে।চাই! যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
: আমার সাথে কথা বলার কী দরকার!
-- চিনতে পেরেছেন?
: তুমি ভুলে গেলেও আমি আজো ভুলতে পারিনি। বাহ! এখন তাহলে তুমি থেকে আপনিতে চলে আসলেন! আমি এতটাই অপরিচিতা আর পর হয়ে গেলাম! তোমরা পুরুষ মানুষ সব একই।
বুঝতে পারলাম, সুমাইয়া দ্বীনকে এখনো আঁকড়ে ধরতে পারেনি! কিন্তু মায়ের কাছে শুনেছি সুমু দ্বীনের ব্যপারে যথেষ্ট কিছু শিখেছে, জেনেছে। তাহলে গায়রে মহরামের হুকুমের ব্যপারেও জানার কথা!
তবে হ্যাঁ দ্বীন সম্পর্কে জানা আর মানা অনেক তফাৎ। কেউ অনেক মাসয়ালা - মাসয়ালা জেনেও আমল করে না। আসলে দ্বীনকে ভালোবাসতে হয়, দীর্ঘ প্রেক্টিস করতে হয়। আর ধৈর্যের গুণ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নিয়ামত। দ্বীন পালন করে মানে তো সম্পূর্ন নিস্পাপ নয়।
আসলে আমি নিজেও পরিপূর্ণ দ্বীনদার হয়ে উঠতে পারিনি, নিজের ভেতরেও কাজ করে, দ্বীনদার ব্যক্তি গুনাহ করতে পারে না বা ভুল করতে পারে না! কিন্তু প্রিয় নবী (স:) ছাড়া কেউই নিস্পাপ নয়। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাওয়াটা জরুরি।
আমি কী থেকে কী ভাবতে লাগলাম। যাক শেষপর্যন্ত সুমু আমার সাথে দেখা করতে রাজি হলো। সাথে সুমাইয়ার ভাইকেও নিয়ে আসতে বলেছি, যাতে মহরাম সাথে থাকে।
জানি না তাকে কী বলবো? কীভাবে বলবো।
আজ শুক্রুবার, মনের মধ্যে এক অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে। সুমুর সাথে দেখা হওয়ার তাড়া! খুব ভোরেই রওয়ানা দিলাম; একটু তাড়াতাড়িই রেডি হয়ে নিয়েছি। মা'ও জিজ্ঞাস করলো, আজ এতো তাড়াতাড়ি কেন?
নিজের মনকে বার বার অন্য কিছুতে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি! যাতে সুমাইয়ার খেয়াল মনে না আসে। কারণ ওর প্রতি আমার অন্যরকম দুর্বলতা! শয়তান যেটার সুযোগ নিবে!
চলবে,,,,